Logo
×

Follow Us

জলবায়ু পরিবর্তন

বায়ুদূষণে দেশের মানুষের গড় আয়ু কমেছে ৬ বছর ৮ মাস

Icon

সিনিয়র রিপোর্টার

প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৩:৫৭

বায়ুদূষণে দেশের মানুষের গড় আয়ু কমেছে ৬ বছর ৮ মাস

বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয় শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩ এর তথ্য অনুযায়ী বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বের সব মানুষের গড় আয়ু দুই বছর চার মাস কমছে। অপরপক্ষে বাংলাদেশের একজন নাগরিকের গড় আয়ু কমেছে ৬ বছর ৮ মাস।

আজ মঙ্গলবার (২৬ সেপ্টেম্বর) ‘বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার। বাপা আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়েছে।

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডিজিজেস অফ দ্য চেস্ট হসপিটাল ২০২১ সালে আউটডোর এবং জরুরি বিভাগ মিলিয়ে ২ লাখ ১০ হাজার রোগী চিকিৎসাধীন ছিল। সাত বছর আগে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৮৫ হাজার। অন্যদিকে রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি, আউটডোর, জরুরি বিভাগ মিলে রোগীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের কিছু বেশি। এবারের ২০২৩ জুলাইয়ে সেই সংখ্যা ১৪ হাজার পার হয়েছে। আয়ুষ্কালের পরিপ্রেক্ষিতে বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা, দূষণ বাংলাদেশে মানব স্বাস্থ্যের জন্য দ্বিতীয় বৃহত্তম হুমকি বলে জানিয়েছে কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স- ২০২৩। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, সীসা দূষণের ফলে বাংলাদেশে প্রতি বছর হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে ১ লাখ ৩৮ হাজারও বেশি মানুষ এবং এ কারণে শিশুদের আইকিউ কমে যাচ্ছে এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।

জেলাভিত্তিক দূষিত শহরের তালিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত বায়ু দূষণ বিষয়ক ‘এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩’ বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজীপুরের বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা, যার ব্যাস সাধারণত ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার বা এর চেয়ে ছোট (পিএম ২ দশমিক ৫)- এর পরিমাণ প্রতি ঘনমিটারে ৮৯ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম পাওয়া যায়। এ মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানমাত্রার (অর্থাৎ ৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে ১৮ গুণ বেশি এবং নির্ধারিত (বার্ষিক) মান মাত্রার চেয়ে ৬ গুণ বেশি। ২০২২ সাল পর্যন্ত অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ২ দশমিক ৫ এর জন্য নির্ধারিত (বার্ষিক) প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। এক্ষেত্রে সবচেয়ে কম দূষিত জেলা হিসেবে পাওয়া গেছে সিলেট শহর। যার প্রতি ঘনমিটারে ৪৮ দশমিক ৫ মাইক্রোগ্রাম বস্তুকণা পাওয়া গেছে এবং এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে ৯ দশমিক ৭ গুণ বেশি ও বাংলাদেশের নির্ধারিত জাতীয় আদর্শ (বার্ষিক) মানমাত্রার চেয়ে ৩ দশমিক ২৩ গুণ বেশি।

তিনি জানান, গাজীপুর ছাড়াও নোয়াখালীতে প্রতি ঘনমিটারে ৮৮ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম, কুমিল্লাতে প্রতি ঘনমিটারে ৮৮ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম, চাঁদপুরে প্রতি ঘনমিটারে ৮৭ দশমিক ৮ মাইক্রোগ্রাম, ঢাকায় প্রতি ঘনমিটারে ৮৭ দশমিক ২ মাইক্রোগ্রাম, নারায়ণগঞ্জে প্রতি ঘনমিটারে ৮৬ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় প্রতি ঘনমিটারে ৮৩ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম, কিশোরগঞ্জে প্রতি ঘনমিটারে ৮২ মাইক্রোগ্রাম এবং টাঙ্গাইলে প্রতি ঘনমিটারে ৮১ মাইক্রোগ্রাম অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা ২ দশমিক ৫ এর উপস্থিতি পাওয়া যায়।

বায়ুদূষণের কারণ উল্লেখ করে বাপার যুগ্ম সম্পাদক জানান, বায়ুদূষণের কারণগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক ও আবহাওয়াজনিত কারণ, নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা, ভৌগোলিক কারণ এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব অন্যতম। ক্যাপসের গবেষণা থেকে পাওয়া যায় যে, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণ কাজ থেকে ৩০ শতাংশ, ইটভাটা ও শিল্প কারখানা থেকে ২৯ শতাংশ, যানবাহন থেকে ১৫ শতাংশ, আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ থেকে ৬.৫ শতাংশ, গৃহস্থালি বা রান্নার চুলার কাজ থেকে ৮.৫ শতাংশ এবং বর্জ্য পোড়ানো থেকে ৮ শতাংশ বায়ুদূষণ ঘটে।

আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স-২০২৩ প্রতিবেদন অনুযায়ী বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বের সব মানুষের গড় আয়ু ২ বছর ৪ মাস কমছে। অপর পক্ষে, বাংলাদেশের একজন নাগরিকের গড় আয়ু কমছে ৬ বছর ৮ মাস। এছাড়া ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজিজেস অব দ্য চেস্ট অ্যান্ড হসপিটালে ২০২১ সালে আউটডোর এবং জরুরি বিভাগ মিলিয়ে ২ লাখ ১০ হাজার রোগী চিকিৎসাধীন ছিল। ৭ বছর আগে এ সংখ্যা ছিল মাত্র ৮৫ হাজার। অন্যদিকে রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের জুলাই মাসে হাসপাতালে ভর্তি, আউটডোর ও জরুরি বিভাগ মিলিয়ে রোগীর সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের কিছু বেশি। এবারের (২০২৩) জুলাইয়ে সে সংখ্যা ১৪ হাজার পার হয়েছে।

বাপার সভাপতি নূর মোহাম্মদ তালুকদার বলেন, সরকারের যেমন পরিবেশ রক্ষায় দায়িত্ব আছে। আমাদেরকে পরিবেশ রক্ষায় দায়িত্ব নিতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্ত, সমাজবিরোধী কাউকে যেন কোন দল নমিনেশন না দেয়। আবার, নমিনেশন দিলে আমরা যেন তাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত না করি। তাহলে আমরা আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করতে পারব।

বাপার সহ সভাপতি পরিবেশবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, এই শহরের সাধারণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পয়োঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা ঠিক না হলে এই শহর বাঁচবে না। জল, জমি, বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ হলো অবৈধ অবৈজ্ঞানিক ইট উৎপাদন। উপরের পলিমাটি দিয়ে এই ইট তৈরি হচ্ছে। এটা থেকে আমাদের অবশ্যই বের হয়ে আসতে হবে।

তিনি বলেন, সরকার নীতি করবেন এক ধরণের, আর বাস্তবায়ন করবে অন্যটা এটা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের আগামী প্রজন্মকে যেন দূষণ সহ্য করতে না হয় এর জন্য সরকারকে কাজ করতে হবে।

বাপার যুগ্ম সম্পাদক গাউস পিয়ারী বলেন, ঢাকায় ৮ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে বাকি ৯২-৯৩ শতাংশ মানুষ হেঁটে, সাইকেলে এবং রিকশায় যাতায়াত করে। তারা দূষণ কম করে। দেশে এত উন্নয়ন হচ্ছে, এরপর যদি আমরা সুস্থ থাকতে না পারি তাহলে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন হবে না।

বায়ুমান উন্নয়নে স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ, মধ্যমেয়াদী পদক্ষেপ এবং দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ গ্রহণ করার ব্যাপারে বাপা ১৩টি পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে। দাবিগুলো হচ্ছে-

স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ

নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখতে হবে ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নিতে হবে। শুষ্ক মৌসুমে সিটি কর্পোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে দূষিত শহরগুলোতে প্রতি ২-৩ ঘণ্টা পরপর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা যেতে পারে।

অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়াতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ি এবং ফিটনেস বিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, প্রয়োজনে নম্বর প্লেট অনুযায়ী জোড়-বিজোড় পদ্ধতিতে গাড়ি চলাচলের প্রচলন করা যেতে পারে।

মধ্যমেয়াদী পদক্ষেপ

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে এবং ছাদ বাগান করার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করতে হবে, দূষিত শহরগুলোর আশপাশে জলাধার সংরক্ষণ করতে হবে। আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা করতে হবে। আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসেবে সেন্ড ব্লকের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়াতে হবে। সিটি গভর্নেন্সের প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করতে হবে। সেবা সংস্থার উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্বল্পসময়ে সম্পন্ন করতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ

নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ যত দ্রুত সম্ভব প্রণয়ন করতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়াতে হবে। নিয়মিত বায়ু পর্যবেক্ষণ স্টেশনের (ক্যামস) ব্যাপ্তি বাড়িয়ে ঢাকা শহরের সব এলাকাকে এর আওতাধীন করতে হবে। এছাড়াও বায়ুদূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করতে হবে। পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকর করতে হবে।

সর্বোপরি সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে বায়ুদূষণ সম্পর্কে আরো বেশি তথ্য নির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে ঢাকাসহ সারা দেশের বায়ুদূষণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন সহ সভাপতি অধ্যাপক এম শহীদুল ইসলাম, সংবাদ সম্মেলন পরিচালনা করেন বাপার সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫